বর্তমান সময়ের তরুনদের পছন্দের পেশা ফ্রিল্যান্সিং । বর্তমানে দেশের প্রায় ৫.৫ লক্ষ তরুন এই পেশায় যুক্ত। ফ্রিল্যান্সিং এর সুবিধা হচ্ছে এখানে ৯/৫ টা অফিস করতে হয়না। আপনি বাসায় বসে কাজ করতে পারেন এবং এ পেশায় আপনিই আপনার বস। বাংলাদেশের ফ্রিলান্সাররা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নানা ধরনের কাজ করে থাকে।
ফ্রিল্যান্সিং করার জন্য অনেক ওয়েব সাইট রয়েছে। যেখানে বায়ার ও সেলার(ফ্রিলান্সার) যোগাযোগ করে কাজ করে। বিশ্বের জনপ্রিয় বেশিভাগ ফ্রিল্যান্সিং সাইট পেপালে পেমেন্ট করে থাকে। কিন্ত বাংলাদেশে পেপাল না থাকায় দেশীয় ফ্রিলান্সারা বিদেশে অবস্থানরত আত্মীয়,বন্ধুদের মাধ্যমে ছাড়াও বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে পেপালের মাধ্যমে পেমেন্ট নিয়ে থাকে।
ফ্রিলান্সারদের কাছে বহু প্রত্যাশিত পেমেন্ট সিস্টেমের নাম পেপাল। এর মাধ্যমে খুব সহজেই ডিজিটাল উপায়ে অর্থ লেনদেন করা যায়। এদেশের ফ্রিলান্সারদের অনেক দিনের চাওয়া ছিল এই পেপাল। এই নিয়ে সরকার প্রতিশুতিও দিয়েছে তাদের। বহুল প্রতিক্ষার পর সম্প্রতি দেশে চালু হল পেপালের একটি মানি ট্রানফার সার্ভিস, জুম। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এটি উদ্বোধন করেন ১৯শে অক্টোবর ২০১৭ইং।
জুমকে অনেকেই পেপালের সাথে গুলিয়ে ফেলছেন। এতে তৈরি হয়েছে পেপাল এবং জুম ধুম্রজাল। এ নিয়ে উঠেছে নানা গুঞ্জন। কেউ বলছেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আর পেপালের নাম জুম একই কথা।
চলুন জেনে নেই পেপাল ও জুমের পার্থক্য ও খুঁটিনাটি।
পেপাল (PayPal) কি?
পেপাল (PayPal) একটি মার্কিন কোম্পানি। এটির পুরো নাম পেপাল হোল্ডিংস। যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে। যার সদর দপ্তর ক্যালিফোর্নিয়া, ইউএসএ। বিশ্বের ২০৩টি দেশে পেপাল অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম হিসেবে কাজ করছে। এটি অনলাইন অর্থ স্থানান্তর ও প্রচলিত কাগুজে পদ্ধতির পরিবর্তে ডিজিটাল উপায়ে কাজ করে। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ইন্টারনেট পেমেন্ট কোম্পানি হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ফ্রিল্যান্সারদের কাছে জনপ্রিয় মাধ্যম এটি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, পেপাল বাংলাদেশ এ অনুমতি নেই, এই লিংকে গেলেই দেখতে পাবেন এখানে বাংলাদেশের নাম নেই।
পেপালের সুবিধাসমূহ
আপনাকে পেপাল এর সুবিধা বলে শেষ করা যাবে না। দেশে অনেক ফ্রিল্যান্সার আছে যারা আমেরিকার মতো দেশগুলো থেকে আয় করে কিন্তু পেপাল না থাকর কারনে তারা তাদের আয়কৃত ডলার বাংলাদেশে আনতে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। ঐসকল দেশগুলোতে পেপাল সহজলভ্য হওয়ায় বায়ার পেপাল ছাড়া ডলার পেমেন্ট করতে চান না।
উদাহরন হিসেবে বলা যেতে পারে বাংলাদেশের ব্রাক ব্যাংক এর Bkash এর কথা। বাংলাদেশে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক এর Ucash, ইসলাী ব্যাংক এর Mcash কিংবা মার্কেন্টাইল ব্যাংক এর MyCash সহ অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গুলোর থেকে যেমন বিকাশ যেমন অনেক এগিয়ে আছে ব্যাপার টা ঠিক তেমন।
পেপালের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী অনলাইনে ব্যক্তিগত ও বানিজ্যিক লেনদেন করা যায়। কেনাকাটা, বিল প্রদান, অর্থ উত্তোলন, বিল পরিশোধ, ব্যাংক ডিপোজিট, ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের যাবতীয় লেনদেন এর মাধ্যমে করা যায়।
এছাড়াও আরো একটি সুবিধা হলো পেপালের মাধ্যমে USD ছাড়াও আরো ২৫টি মুদ্রায় অর্থ লেনদেন করা যায়। সহজ কথায় পেপাল ই-ওয়ালেট হিসেবে কাজ করে। এর বাইরে সেফটি এবং সিকিউরিটি অনেক শক্তিশালী হওয়ার কারনে আমেরিকান বায়াররা পেপালে পেমেন্ট দিতে পছন্দ করে।
এবার আমরা জেনে নিব জুম সম্পর্কে।
জুম (Xoom) কি?
আমরা বিদেশে থাকা আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের পাঠানো টাকা ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে গ্রহন করতাম। এখনো করি অনেকে। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ছাড়াও বাংলাদেশে আরো এরকম সার্ভিস চালু আছে। যেমন মানিগ্রাম, রিয়া, ক্লিঙ্ক, এক্সপ্রেস মানি সহ আরো বেশ কিছু সার্ভিস। ঠিক তেমনি এই ধরনের আরেকটি সার্ভিসের নাম Xoom । এর যাত্রা হয় ২০০১ সালে পরে ২০১৫ সালে পেপাল জুমকে কিনে নেয়।
জুম সার্ভিসের সুবিধাসমূহ
- মানি ট্রান্সফার সিস্টেমে জুম নির্দিষ্ট ব্যাংকে একাউন্ট থাকলে মুহূর্তে টাকা উত্তোলন করা যাবে।
- বাংলাদেশে জুমের প্রায় ৬ হাজার ১৫৭টি লোকেশন রয়েছে। উক্ত পয়েন্ট থেকে টাকা তোলা যাবে।
- ব্যাংকের মাধ্যমে সর্বনিম্ন ১ হাজার ডলারের জন্য জুম ৪.৯৯ ইউএস ডলার চার্জ কেটে থাকে। কিন্তু এক হাজার ডলারের ওপরে টাকা পাঠাতে কোন চার্জ নেই অর্থাৎ ফ্রি।
- টাকা উত্তোলন করা যাবে সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও সিটি ব্যাংক থেকে।
জুম সার্ভিসের অসুবিধাসমূহ
- পেপাল ব্যালেন্স থেকে জুম ট্রানজাকশনের জন্য অর্থ পরিশোধ করা যাবে না। পেপাল ব্যালেন্স এর মাধ্যমে শুধু পেপাল সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ক্রেডিট কার্ড এবং ডেবিট কার্ডে অর্থ পরিশোধ করা যাবে।পুরো ব্যাপার গুলোর মধ্যে এটি সব থেকে জটিল এবং গুরুত্বপূর্ন।
ধরাযাক আপনি একজন আমেরিকান বায়ারের কাজ করছেন। তার পেপাল একাউন্ট আছে। কিন্তু সে চাইলেই সরাসরি পেপাল থেকে জুমে আপনার প্রাপ্ত তথ্য পরিশোধ করতে পারবে না। এজন্য তাকে পেপাল সাপোর্ট করে এমন কোনো ব্যাংক একাউন্ট কিংবা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে হবে। এখানে বায়ারের একটি পেপাল একাউন্ট থাকার চেয়েও পেপাল সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যাংকে একাউন্ট থাকা আবশ্যক। - নির্দিষ্ট নয়টি ব্যাংক ছাড়া এই সেবাটি পাওয়া যাবে না এবং উল্লেখিত ব্যাংকে পেমেন্ট গ্রহীতার একাউন্ট থাকতে হবে।
- বছরের ১২ হাজার ডলারের বেশি টাকা আনা যাবেনা।
- আপনাকে যে মুদ্রাই পাঠানো হোক না কেন তা দেশি মুদ্রায় উত্তোলন করতে হবে।
- আপনি জুম থেকে পেপাল একাউন্টে লেনদেন করতে পারবেন না।
- অনেক সময় ফ্রিল্যান্সারদের ডোমেন-হোষ্টিং সহ বিভিন্ন জিনিস কিনতে হয়। তবে জুম এর মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাঠানো বা কেনাকাটা করা যাবে না।
মোট কথা হচ্ছে পেপাল আর জুম এক সেবা নয়। এটি পেপালের একটি সার্ভিস। যার মাধ্যমে টাকা লেনদেন করা যায়। কিন্তু এর সুবিধা সমূল পেপালের মত সুবিধা এতে পাওয়া যাবে না।
তারপর ও কি বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সার রা পেপাল ব্যবহার করছেন না? কিংবা পেপাল এর মাধ্যমে পেমেন্ট আনছেন না?
হ্যা, বাংলাদেশের অনেক ফ্রিল্যান্সার রা পেপালের মাধ্যমে আনছেন। তবে এ পদ্ধতি গুলো সম্পূর্ন অবৈধ এবং বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখ্যীন হওয়ার সম্ভবনা থাকে, আসুন জেনে নেই এভাবে পেপাল ব্যবহার করলে কি ধরনের সমস্যার সম্মুখ্যীন হতে পারেন।
- সাধারণত পেপালে একাউন্ট খোলার সময় পেপাল ব্যক্তিগত তথ্যের প্রমাণ বাধ্যতামূলকভাবে চায় না। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় পেপালের মাধ্যমে বড় কোনো অ্যামাউন্ট লেনদেন করার পর। তখন তারা ট্রানজেকশন ভেরিফাই করার জন্য ফটো আইডির স্কান কপি চেয়ে বসে। কিন্তু আপনার একাউন্ট যদি ভুয়া কোনো তথ্য দিয়ে খোলা থাকে তখন ফটো আইডি ম্যানেজ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তখন পেপাল একাউন্টে থাকা পুরো অর্থ হোল্ড করে রাখে।
- পেপাল একাউন্টটি যদি প্রতারণা করে অন্য দেশের ঠিকানা ব্যবহার করে ও সঠিক তথ্য দিয়ে খোলা থাকে, তারপরও বাংলাদেশ থেকে সেটি ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ। কারন বাংলাদেশে এখনও অফিসিয়ালি পেপালের লেনদেন তালিকায় নেই, তাই আপনি যদি বাংলাদেশের আইপি ব্যবহার করে পেপালে লগইন করেন কিংবা এর মাধ্যমে লেনদেন করলে পেপাল সেটি বুঝে ফেলে। তখন পেপাল একাউন্টের সত্যতা যাচাই করার জন্য একাউন্ট সম্পর্কিত বাড়তি তথ্য চায়।
যেমন একাউন্ট হোল্ডার এর ব্যাংক স্টেটমেন্ট বা ইউটিলিটি বিলের স্ক্যান করা কপি চাইবে। যেহেতু একাউন্ট টি আসল নয় তাই সে তথ্য গুলো সঠিক ভাবে না দিতে পারলে পেপাল একাউন্টটি লিমিটেড করে দেয়। - অবৈধ উপায়ে খোলা পেপাল একাউন্ট দিয়ে কোনো কিছু কিনতে গেলে চেকআউটের সময় বিলিং অ্যাড্রেস সেই দেশের ঠিকানাই শো করবে। অর্থাং পেপাল একাউন্ট খোলার সময় যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে সেটাই আসবে। তবে এটি যে পরিবর্তন করা যাবে না তা নয়। কিন্তু প্রতিবার শপিংয়ের সময় ঠিকানা এডিট করলে পেপালের দৃষ্টিতে এটিকে ভালো ভাবে নেয় না।
তাই বলা যায় অবৈধ উপায়ে পেপল একাউন্ট খোলা এবং অর্থ লেনদেন করা ২টাই খুব ঝুকিপূর্ন। এতে যেকোনো সময় একাউন্টে থাকা সমস্ত অর্থ সহ পুরো একাউন্ট টি ডিজেবল হয়ে যেতে পারে।
আশা করছি লেখাটি আপনাদের ভালো লেগেছে, তাই দয়াকরে পোষ্টটি সবার সাথে আপনার সোশ্যালে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।